Saturday, April 19, 2025

রেলের ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি দখল, ৪ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি তদন্ত কমিটির সুপারিশ

Share

নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের সর্ববৃহৎ রেল কারখানা অবস্থিত। অথচ এখানেই রেলের ভূসম্পত্তি অবৈধভাবে দখল প্রক্রিয়া অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে। দখল ঠেকাতে ৪ বছর আগে জমা দেওয়া রেল মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির ২৪ দফা সুপারিশমালা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৯৮৫ সালে এক চুক্তির অধীনে ২৫ দশমিক ৭৫ একর জমি সৈয়দপুর পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে। চুক্তির অধীনে জমির মালিকানা রেলের থাকার কথা।

পৌর কর্তৃপক্ষ ওই জমিতে থাকা হাট-বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করে আহরিত রাজস্বের একটি অংশ রেলকে দেওয়ার কথা।

কিন্তু পৌরসভা চুক্তির ভিন্ন অর্থ করে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে, হস্তান্তরিত ২৫ দশমিক ৭৫ একর জমির মালিকানা তাদের। এরপর থেকেই তাদের প্রশ্রয়ে শুরু হয় সীমাহীন দখলদারীর মহোৎসব।

পৌর কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত হাট-বাজার থেকে প্রাপ্ত আয়ের অংশ চুক্তি অনুযায়ী রেলকে দেয়নি।

রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হস্তান্তর করা জমির সীমানা সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত না করায়, পৌর কর্তৃপক্ষ এর দ্বিগুণ এলাকায় দখলদারত্ব বজায় রেখেছে। রেল কর্তৃপক্ষ কয়েকবার জমি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিলেও পৌর কর্তৃপক্ষ সেসব পদক্ষেপ নস্যাৎ করে দেয়। 

পরে ২০২০ সালে স্থানীয় সাংবাদিক মোতালেব হোসেন রেলের জমি দখল ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগ দায়ের করেন। 

দুদক অভিযোগটির বিষয়ে রেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটি  ২০২১ সালের মধ্যভাগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা দুর্নীতিগ্রস্ত রেল কর্মকর্তা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহায়তায় শুধু সৈয়দপুরে ৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের ৩৫০ একর ভূমি দখল করেছে।

একইসঙ্গে তদন্ত কমিটি কয়েকজন ভূমিদস্যুসহ তাদের সহায়তাকারী রেল কর্মকর্তা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যদের চিহ্নিত করে জরুরিভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ভূসম্পত্তি রক্ষায় বাস্তবসম্মত ২৪ দফা সুপারিশ প্রদান করে।

রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় যে, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য ২ হাজার ৪৮৮টি রেল কোয়ার্টারের ৭০ শতাংশ দখল হয়ে গেছে।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে অভিযোগকারী মোতালেব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দাখিলের প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও কোন কার্যকরী ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখনো দুর্বার গতিতে ভূমি দখল অব্যাহত রয়েছে।’

নতুন দখলের প্রমাণ হিসেবে মোতালেব বলেন, ‘সৈয়দপুর শহরের শহীদ ডা. জিকরুল হক ও শহীদ শামসুল হক রোডের দুই পাশে গত কয়েক মাসের মধ্যে আটটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।’

স্থানীয় এই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘সাহেবপাড়া মহল্লার জনৈক মঞ্জুর দখলকৃত রেলভূমি ও রেলের জলাশয় অবৈধভাবে ভরাট করে দশটি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন।’ 

সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের ফল ব্যবসায়ী শাহ আলম কয়েকমাস আগে দখল করা রেলের জমিতে একটি বহুতল মার্কেট করেছেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সদম্ভে জানান, রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের জানিয়ে তিনি মার্কেট নির্মাণ করেছেন।

তদন্ত কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানতে পারে, অবৈধভাবে দখল করা রেলের জমিতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ,  জাতীয় পার্টিসহ ছয়টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের উপজেলা শাখার প্রধান অফিস দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

রিপোর্টে বলা হয়, সৈয়দপুর শহরের দখলকৃত রেলওয়ের জমিতে ৩৬টি বহুতল আবাসিক ভবন, ২৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা, ৪৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ১৫০টি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাকেন্দ্র ও ৫ হাজার দোকানঘর রয়েছে।

রিপোর্টে প্রধান দখলদার হিসেবে সৈয়দপুর উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোকছেদুল মোমিনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়। এতে অভিযোগ করা হয়, তিনি কোটি কোটি টাকা মূল্যের রেলের জমি দখল করে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন এবং সেগুলো বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।

মোমিন ছাড়াও অন্যান্য বড় দখলদাররা হলেন—স্থানীয় ব্যাবসায়ী নেতা আলতাফ হোসেন, জাতীয় পার্টির নেতা জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী বাবু আলী, আতিকুর রহমান।

এতে উল্লেখ করা হয়, জয়নাল আবেদীন বেআইনিভাবে রেলের রেশন শপ ভেঙে সেখানে চার তলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, আলতাফ হোসেন রেলের জমিতে অবৈধভাবে ১২টি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। 

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সৈয়দপুর উপজেলা সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম তার লায়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য বহুতল ভবন বানিয়েছেন রেলের জমিতে।

তবে অভিযুক্তদের সবাই তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জানতে চাইলে জাপা নেতা জয়নাল আবেদীন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বৃটিশ আমলে নির্মিত জীর্ণ রেলের রেশন শপটি আগে থেকেই ভাঙা ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই আমি ১৯৮৪ সালে এটি রেল বাজার ম্যানেজমেন্ট কমিটি থেকে ৯৯ বছরের জন্য বৈধভাবে লিজ নিয়ে সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছি। সৈয়দপুর পৌরসভা মার্কেটের ডিজাইন ও প্ল্যানিং যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে অনুমোদন দিয়েছে।’

তবে রেলের এস্টেট ডিপার্টমেন্ট সূত্র জানায়, রেলওয়ে বাজার ম্যানেজমেন্ট কমিটি ৯৯ বছরের জন্য কাউকে লিজ দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না।

সরেজমিন পরিদর্শনে তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, অনেক দখলদার তাদের অপকর্ম ঢাকতে দখলকৃত জমির একাংশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে।

এমন একটি প্রতিষ্ঠান শামসুল হক মেমোরিয়াল একাডেমি, যেটি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোকছেদুল মোমিন তার প্রয়াত বাবার স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করেছেন।

উদ্বেগের বিষয় হলো, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি  সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সংবেদনশীল ‘কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই)’ এলাকার জমি দখল করে বিপজ্জনকভাবে স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এটি রেল কারখানার একটি গুরুত্বপূর্ণ গেটের কাছে অবস্থিত, যার পাশ দিয়ে রেল লাইন কারখানায় ঢুকে গেছে ক্ষতিগ্রস্ত রেল ক্যারেজ ও ওয়াগান মেরামতে নিয়ে আসার জন্য।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেসময় নীলফামারী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও তৎকালীন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি দখলকৃত জমিতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন। 

স্কুলটি অবৈধ জমিতে প্রতিষ্ঠিত জেনেও তিনি এর উদ্বোধন করেছিলেন, কারণ মোকছেদুল মোমিন তার গ্রুপের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন।

তৎকালীন রেল কারখানার ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্টন নূর আহমেদ হোসাইনও অনুষ্ঠানটিতে বিশেষ অতিথি ছিলেন। অথচ, তিনি ছিলেন কারখানা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত।

জমি দখলের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বর্তমান বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আত্মগোপনে থাকায় মোমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

তবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

সে সময় তিনি বলেছিলেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে রিপোর্ট দাখিল করেছেন।

শামসুল হক মেমোরিয়াল একাডেমি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং, রেল কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের যৌথ সিদ্ধান্তে এটি তার বাবার নামে করা হয়েছে, কারণ তিনি কারখানার একজন সুপরিচিত শ্রমিকনেতা ছিলেন। 

তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে তদানীন্তন সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র ও সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার ভূমি দস্যুদের ব্যাপকভাবে বহুতল ভবন নির্মাণে সহায়তা করেন। 

তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পৌরসভার এই দখলদারি চলছে আদালতের আদেশকে অমান্য করেই।

রিপোর্টে বেশ কিছু সুপারিশের মধ্যে ছিল, রেলের সম্পত্তি রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য সৈয়দপুর রেল কারখানার তৎকালীন ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট, এস্টেট ডিপার্টমেন্টের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, রেল পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় শাস্তিমূলক গ্রহণ করা হোক।

রিপোর্টে চিহ্নিত ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং সেইসঙ্গে মামলা পরিচালনার জন্য দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের জন্য জোর সুপারিশ করা হলেও এর কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।

সৈয়দপুর শাখা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক মাজহারুল আনোয়ার শামীম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সৈয়দপুরে রেলের ভূমি দখলের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে তদন্ত কমিটির ২৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করার বিকল্প আর কিছু নেই।’

এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রেলের দখলকৃত ভূমি উদ্ধারে আমরা অত্যন্ত আন্তরিক। এখন আমরা আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি, যেন দখলদারদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’

‘ইতোমধ্যে আমরা অবৈধ অবকাঠামো সরিয়ে নেওয়ার জন্য নোটিশ দিয়েছি,’ যোগ করেন তিনি।

Read more

Local News