২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর দ্রুততম সময়ে খুনিদের ধরার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও কয়েক মাসের মধ্যেই এই হত্যার তদন্ত চূড়ান্ত রকমের লেজেগোবরে করে ফেলেছিল শেখ হাসিনার সরকার। এমন বাস্তবতায় মেহেরুন রুনির কর্মস্থল এটিএন বাংলার নিউজরুমে একদিন আলাপ চলছিল। তখন আমি সংবাদকর্মী হিসেবে ওই চ্যানেল কর্মরত ছিলাম। আলাপে বার্তাকক্ষের জ্যেষ্ঠ এক সদস্য বলেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশে হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এতটাই জল ঘোলা হয়েছে যে, চূড়ান্ত নিরপেক্ষ ও যথাযথ তদন্ত সম্পন্ন হলেও কেউ তা বিশ্বাস করবে না। তাই কোনো সরকারই সত্য প্রকাশের ঝুঁকি নেবে না। তবে হ্যাঁ, কোনো অলীক পরাবাস্তবতায় সাগর-রুনি মধ্যে কেউ যদি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়ে কোনো টিভিতে লাইভে তাদের হত্যার বর্ণনা দেন, কেবলমাত্র তাহলেই এই ঘটনার সুরাহা হতে পারে। খুনী শনাক্ত হতে পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই কথাগুলো কেমন যেন অমোঘ বাণী হয়ে এখনো আমার কানে বাজে।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর অনেকের মতো আমিও আশায় বুক বেঁধেছিলাম এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০ দিনের মাথায় তখনকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আশ্বাস বাণীও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আগে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রহসন হয়েছে। নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব ছেড়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়সও এক বছর হতে চলছে। কিন্তু ফলাফল লবডঙ্কা। প্রহসন চলমান। দেশবাসী অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারে সামান্য অগ্রগতিও হয়নি। চলছে আওয়ামী সরকারের ধারাবাহিকতা, অনাকাঙ্ক্ষিত কালক্ষেপণ।
অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আলোচিত এই হত্যার তদন্তে আদালতের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে চার সদেস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করেছে। একইসঙ্গে তদন্ত শেষ করতে ছয় মাসের সময়ও দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশনা ছিল এই ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু ছয় মাস পর টাস্কফোর্স আদালতের কাছে সময় চেয়েছিল আরও নয় মাস। আগামী ডিসেম্বরের আশপাশে জাতীয় নির্বাচন হলে অন্তর্বর্তী সরকারেরই তো দায়িত্বে থাকার কথা নয়। যাই হোক, আদালত আরও ছয় মাসের সময় দিয়েছে। কিন্তু এই সময়েও এই হত্যার রহস্য উদঘাটনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে আমার ধারণা।
এটিএন বাংলার সংবাদকর্মী হিসেবে আমি নিজে দীর্ঘদিন এই হত্যার তদন্ত ফলো করেছি। দিনের পর দিন র্যাব হেডকোয়ার্টারে দৌড়াদৌড়ি করেছি। উল্লেখ্য এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের দেওয়া এক আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব র্যাবকে দেওয়া হয়েছিল। এর আগে মামলার তদন্ত করছিল সিআইডি। আমার দৃঢ় ধারণা, সিআইডি এই মামলার রহস্য উন্মোচনের খুব কাছাকাছি ছিল। কিন্তু অদৃশ্য কোনো কারণে মামলার তদন্তের গতিমুখ বদলে ফেলা হয়। যার ফলে আজও দিশেহারা এই মামলার তদন্ত কাজ।
হত্যাকারীর হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া কোনো মায়ের সঙ্গে আপনারা কেউ কোনোদিন কথা বলেছেন? হয়তো না। এটিএন বাংলার সংবাদকর্মী হিসেবে আমি কয়েকবার সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনিরের সঙ্গে কথা বলেছি। আজও মনে পড়ে পুরাতন ঢাকায় সাগর সরওয়ারের বাড়িতে আমি যতবার গেছি, ঠিক ততবার এক মায়ের হাহাকার ও আর্তনাদ দেখেছি, যা ছিন্নভিন্ন করেছে আমার হৃদয়। নিশ্চিতভাবেই ঠিক একই অবস্থা মেহেরুন রুনির পরিবারের। মেয়ের হত্যাকারীদের দেখার আগেই পরপাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন মেহেরেুন রুনির মা। মেঘও এখন প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও এই হত্যার রহস্য উন্মোচনে বাধা কোথায়? এখনো ঠিক কেন সত্য প্রকাশে অনীহা? কেন অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘসূত্রতা? কেনই বা কালক্ষেপণ? অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার নয় মাসেও আলোচিত এই হত্যা মামলার অগ্রগতি না হওয়া হতাশাজনক। একইসঙ্গে এই প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে, আদৌ কি এই হত্যা রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী অন্তর্বর্তী সরকার?
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা