ঢাকা: গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
সিপিডি কার্যালয়ে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিন বলেন, এ মুহূর্তে পাকিস্তানের বাজার বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত নয়। আর দীর্ঘদিনের সার্ক কার্যকর হলে পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ।
প্রশ্ন: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান, ভারত, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কী পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গত ৫ আগস্টের পরিবর্তনটা হয়েছে রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তুলনায় দেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করেছে। বহির্বিশ্বও বাংলাদেশ সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেন প্রশাসন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বেলায়ও কিছু গুণগত পরিবর্তন হবে। কারণ, বৈশ্বিক পর্যায়ে আমেরিকার ফার্স্টনীতি, যাকে ‘আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ বলে সেই নীতিতে এগোবে ট্রাম্প প্রশাসন। নিজের স্বার্থ রক্ষায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলো ভিন্নভাবে দেখা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন: ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন পড়বে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ভারত বলছে বলে আমি বলছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্কে যে একটা নতুন পরিণতির দিকে যাচ্ছে, সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন চীনের পণ্যের ওপর যদি যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক আরোপ করে তখন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের দাম বাড়বে। এতে মার্কিন নাগরিকরা অন্য দেশের পণ্যের দিকে ঝুঁকবেন, বিকল্প উৎস থেকে পণ্য খুঁজবেন মার্কিন বায়াররা। সেটা বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যিক সুযোগ হতে পারে। অন্যদিকে চীন চাইবে উদীয়মান দেশগুলোর সঙ্গে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে। এটা বাংলাদেশের বাণিজ্য বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল। তবে সম্পর্ক অতিব্যবহার হয়েছে। ভারত তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এটাও ঠিক যে, ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানির উৎস। প্রায় ১৩-১৪ বিলিয়ন ডলার আমরা ভারত থেকে আমদানি করি। ভারতের ষষ্ঠ বা সপ্তম রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের প্রয়োজনীয়তা ও আমদানিতে স্থলভাগ ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে আমাদের। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিষয়ে ভারতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে।
প্রশ্ন: অর্থনীতি বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ভারতকে একটু পাশ কাটিয়ে অন্যদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো যাবে কি না। যেমন বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ভারতের বন্দর ব্যবহার না করে মালদ্বীপের বন্দর ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েকটি ক্ষেত্রে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: পূর্ববর্তী সরকারের আমলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেন কম ছিল, যা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তান থেকে ৭৮০ মিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ, রপ্তানি হচ্ছে ২৩০ মিলিয়ন ডলারের মতো। অথচ ভারতে আমরা পণ্য রপ্তানি করছি ২ বিলিয়ন ডলার আর আমদানি করছি প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। বিপুল পরিমাণ এই আমদানি ও রপ্তানির উৎস নতুন করে খুঁজতে হবে। যেমন আমাদের পণ্যগুলো বিকল্প বাজারে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে কি না। কিন্তু ভারতের বাজারে আমাদের পণ্যের যে চাহিদা রয়েছে তা কিন্তু এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের বাজারে নেই। এদিকে চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ ভালো। হংকং থেকে আমরা ভারতের চেয়েও কম খরচে পণ্য আমদানি করতে পারি। অর্থাৎ চীন এ ক্ষেত্রে নতুন কোনে উৎস নয়। আবার আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর কম হওয়ার কারণে চীনে আমরা রপ্তানি বাড়াতে পারছি না। চীনের শূন্য শুল্ক সুবিধা নিতে পারছি না। সুতরাং রুট বদলে দিলেই আমরা সুবিধাটা পাব না। পাকিস্তান থেকে পণ্য পরিবহনে বড় জাহাজে আমদানি-রপ্তানিতে সেই ধরনের চাহিদা থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এখন যেটা হচ্ছে করাচি থেকে ২৮ দিন পর পর একটা সাইকেলে (চক্রে) জাহাজগুলো আসে। আর কোনো একটা দেশের সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য করতে হলে এতো দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির চাহিদা ঠিক রাখতে পারব না। বরং যেটা করা দরকার, বাণিজ্যিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে আরও পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগের সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে পণ্য আদান-প্রদানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম কিংবা দুবাই হয়ে চট্টগ্রাম এটা কার্যকর হবে না। সুতরাং ভারতকে পাশে রেখেই আমাদের চিন্তা করতে হবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে রপ্তানি-আমদানির কীভাবে বাড়াতে পারি।
প্রশ্ন: চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়ানোর উপায় কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: চীনের সঙ্গে এই মুহূর্তে আমাদের দুই ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। একটি হলো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মুক্তবাণিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ-আরসেপ। যেখানে চীন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো ১২টি দেশ রয়েছে। সেই আরসেপে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। কম শুল্কে সেখান থেকে আমরা পণ্য আমদানি করতে পারব। আরেকটি হচ্ছে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে আমরা কম্প্রেহেনসিভ পার্টনারশিপে যেতে পারি কি না। শূন্য শুল্ক করের সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে আমরা রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়াতে পারছি না। কারণ, তাদের শর্ত অনুযায়ী ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন করতে হবে। এতো উচ্চ মূল্য সংযোজন আমরা খুব বেশি পণ্যে করতে পারি না। আর এই শর্ত থেকে বেরিয়ে আসার উপায় চীনের সঙ্গে সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তিতে যেতে পারি। যেখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সেবা সবই থাকবে।
প্রশ্ন: বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তাহলে কী হতে পারে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ইতোমধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ভেতরে অবকাঠামোগত, জ্বালানিগত খাতে এবং সড়কের প্রকল্প রয়েছে। স্বাভাবিক গতিতে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। আমরা চাচ্ছি আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে চীন বিনিয়োগ করুক। চীন যেন তাদের উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং আমাদের ডোমেস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে আরও বেশি করে নিয়ে আসে। চীন যদি তার সোলার বেজড ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং বাংলাদেশে করে তবে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে একটা সুযোগ বৃদ্ধি করবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে চায় পাকিস্তান। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: ওষুধ আমদানিকে অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবে দেখব। আমাদের ওষুধশিল্প খুবই সমৃদ্ধ। আমরা ১০১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করি, ৬০০ মিলিয়ন বা তার কিছু কম রপ্তানি আয়। যদিও বড় পরিসরে রপ্তানি হচ্ছে না। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি শুরু হয়েছে। পাকিস্তানে রপ্তানি একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। তবে কম পণ্য দিয়ে একটা ট্রেড রুট চালানো সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে দুবাই হয়ে শিপমেন্ট করেও সেখান থেকে করাচিতে রপ্তানি করা যায়। এটা আরও সাশ্রয়ী হবে সরাসরির চেয়ে। এ কারণেই কিন্তু হাবগুলো গড়ে ওঠে। যেমন শ্রীলঙ্কা একটি হাব, দুবাই একটি হাব। আমি যে কথাটা বলছি, আমাদের নিয়মিত বাণিজ্যিক চুক্তি, রুট ঠিক থাকুক। রাজনৈতিক সম্পর্কের পতনের কারণে যেন একটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যেটা আগের সরকারের সময়ে হয়েছে। আরেকটি বড় সুযোগ সার্ক। আমরা সার্ককে দীর্ঘদিন অবহেলা করেছি। ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জন্য সার্ক কার্যকরী হচ্ছে না সেভাবে। সার্কের অধীনে মোটর ভিহিক্যল চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা। সেটা ড্রাফ্ট (খসড়া) হয়েই পড়ে আছে। ওটা হলে পাকিস্তান থেকে স্থল দিয়ে ভারত হয়ে আমরা বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি করতে পারতাম।
প্রশ্ন: পাকিস্তান হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান রুটে বিমান চলাচল শুরু হবে, এতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান কেমন হবে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট নেই, দুবাই হয়ে যেতে হয়। এটা ব্যয়বহুল। সরাসরি হলে ব্যয় কমবে। কিন্তু সরাসরি বা পূর্ণাঙ্গ রুট চালু হওয়া মানে দুই দেশের মধ্যে সেই পরিমাণ বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা। যাতে অনেক বেশি লোক আসা-যাওয়া করে। পাকিস্তানের সঙ্গে এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মানুষজন চলাচল বেশি মাত্রায় নেই। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত একটি ফ্লাইট চালানোর মতো সম্ভাব্যতা কতটা রয়েছে সেটা বড় প্রশ্ন। কোনো ফ্লাইটই তো লোকসান দিয়ে চালাবে না। সপ্তাহে একটি-দুটি ফ্লাইট হতে পারে। যেমন ইজিপ্ট এয়ারলাইনকে আমরা দিচ্ছি। পাকিস্তানও সেটা করতে পারে।
প্রশ্ন: দুর্বল ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে। তারপরও গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। ডলারের দামও বেড়ে গেছে। তারল্য সংকট কাটাতে এই নোট ছাপানোর সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ছিল?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমার মনে হয় একটি জায়গায় সরকারকে নীতিগত ও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। সেটা হলো কিছু ব্যাংককে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ, যতই লিকুইডিটি সাপোর্ট দেন, এই ব্যাংকগুলো কোনোভাবেই তার ঋণের উত্তরণ ঘটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে না। টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করে এসব ব্যাংক দীর্ঘদিন চালানো যাবে না। বলতে পারেন এসব ব্যাংক তলাবিহীন হয়ে গেছে। তবে এসব ব্যাংক বন্ধ করার আগে সেখানে আমানতদারদের বিষয়ে ভাবতে হবে, কীভাবে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২৫
এসএএইচ