সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১৯ আগস্ট জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এই আদেশ দেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
জনস্বার্থে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ গত ১৯ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। অন্য চারজন হলেন—অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। এর মধ্যে বদিউল আলম মজুমদার বর্তমানে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান। আর তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই রিটে পরবর্তীতে বিএনপি ও জামায়াতও যুক্ত হয়।
২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়াসহ অনেকগুলো পরিবর্তন আনা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১৫৩টির মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলো সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
প্রশ্ন হলো, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়েছে? অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল বা অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংবিধান কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে তথা চতুর্দশ সংশোধনীর পরের অবস্থায় ফিরে গেল, নাকি এখানে আরও কিছু জটিলতা আছে?
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হয় ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে—যে বিধানের আলোকে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালে এই বিধানটি বাতিল করে দেওয়ার ফলে ২০১৪, ২০১৮ এবং সবশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে—যে নির্বাচনগুলো দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়—এমন যুক্তি দেওয়া হলেও যেহেতু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, অর্থাৎ যেহেতু একটি দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাদের অধীনে নির্বাচন হলে সেটি প্রভাবমুক্ত হওয়া কঠিন এবং সব রাজনৈতিক দল তো বটেই, সাধারণ মানুষও নির্বাচনটি অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে চায় না, ফলে যখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল করে দেওয়া হয়, তখনই একটি বিরাট রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হলো মনে করা হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনটি হয়েছিল আওয়ামী লীগের অধীনে এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনেই তারা জয়ী হয়। বাংলাদেশের প্রথম এই নির্বাচনটিও যে শতভাগ বিতর্কমুক্ত ছিল না তা ওই সময়ের পত্র-পত্রিকা ও বইপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে তখন আওয়ামী লীগের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করতো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও নির্বাচনটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত থাকলে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা দলগুলো হয়তো ৩০-৪০টা আসনে পেত বলে মনে করা হয়।
জিয়াউর রহমানের আমলে যে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন জয়, সেখানেও তার দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তখন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল, তাতে নির্বাচনটি অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসত। কিন্তু তারপরও ওই নির্বাচনটিও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না।
তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে। স্বাভাবিকভাবে ওই দুটি নির্বাচনে তার দলই জয়ী হয়। তবে এই দুটি নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে এরশাদের জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসতো কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম চারটি নির্বাচনের একটিও শতভাগ গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। এরকম বাস্তবতায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি হয় দলীয় সরকারের প্রভাবের বাইরে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা না হলেও মডেলটা ছিল সেরকমই এবং এই প্রথম দেশের কোনো একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ এই নির্বাচন নিয়ে খুব বড় কোনো সমালোচনা হয়নি।
বস্তুত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগ থেকেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে এবং তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই দাবিতে সরকারের বিরোধী সব দল একাট্টা হয়। বিরোধীদের চাপে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়।
সংবিধানে এর পরে অর্থাৎ চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে। উদ্দেশ্য ছিল সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৩০টি থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা এবং পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা। একইসঙ্গে এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বয়সসীমাও ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ বছর করা হয়। তার মানে এই সংশোধনীর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই—যে বিধানটি যুক্ত করা হয়েছিল এর আগে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। অর্থাৎ চতুর্দশ সংশোধনীর পরেও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল। সুতরাং পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধান চতুর্দশ সংশোধনীর সময়ে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় ফিরে যাবে, এটিই স্বাভাবিক হিসাব। কিন্তু আসলে কি তা-ই?
বাস্তবতা হলো, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত হবে না। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রক্রিয়াটি যখন চলছিল তখন ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন আপিল বিভাগ এবং এর মাস দেড়েক পরে ৩০ জুন সংসদে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী।
সংবিধান গবেষক আরিফ খানের যুক্তি হলো, যেহেতু আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাদ দেওয়া হয়, সুতরাং এখন হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দিলেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে না। কারণ হাইকোর্ট কখনো আপিল বিভাগের রায় বাতিল বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না। তার মানে এখানে একটা জটিলতা রয়ে গেছে।
তাহলে সমাধান কী? তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি রিভিউ বা পুনর্বিবেচনা চেয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, সেটির নিষ্পত্তি হতে হবে। রিভিউতে যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল করা হয়, অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়টি যদি রিভিউতে বাতিল হয়ে যায়, তাহলেই কেবল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হতে পারে। আগামী ১৯ জানুয়ারি এই রিভিউয়ের ওপর শুনানির কথা রয়েছে। গত ১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা আরও সময় চেয়ে আবেদন করলে শুনানির নতুন তারিখ দেওয়া হয়।
তার মানে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি ফিরবে না। বরং সেইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়েও সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত লাগবে। যদিও এরকমটিও মনে করা হয় যে, পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হলেও, সংসদ যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনে, তখন আর আদালতের ওই রায়টি খুব বেশি প্রাসঙ্গিক থাকে না। পক্ষান্তরে সংসদ যে আইনই করুক না কেন, এমনকি সেটি যদি সংবিধান সংশোধনও হয়, তারপরও উচ্চ আদালত যদি মনে করেন যে ওই আইন কিংবা সংশোধনীটি সংবিধানের মৌলিক চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, তাহলে সেটি বাতিল বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ যদি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং রিভিউ হয়, তাহলে সেই আপিল ও রিভিউয়ের নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল বলে মনে করার সুযোগ নেই।
অতএব সরকার যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে চায়, তাহলে তার আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী এবং একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এও ঠিক যে, বর্তমানে যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আছে, তারাও এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে তাদের অধীনে নির্বাচন হতেও কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক