‘বাংলাদেশে ঢুকে উৎসব করে গেছেন আরাকান আর্মির সদস্যরা’। ২১ এপ্রিল এমন একটি খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বলা হচ্ছে, ১৬ ও ১৭ এপ্রিল বান্দরবানের থানচির রেমাক্রি ইউনিয়নের ঝিরিমুখ এলাকায় পাহাড়িদের নিয়ে জলকেলি উৎসবে অংশ নিয়েছেন আরাকান আর্মির সদস্যরা।
এর কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই এলাকায় মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে ‘আরাকান ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল’ নামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, চারদিনের সফরে এসে গত ১৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মিয়ানমারে লড়াই বন্ধ ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, এর প্রথম ধাপ হবে সহিংসতা বন্ধ করা এবং একইসঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা, যা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করবে—যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে।
এ সময় তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন ও তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ জরুরি বলেও উল্লেখ করেন।
বস্তুত এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দিয়ে যান। এর পাঁচদিনের মাথায় ২০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দলও রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের কার্যকর যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।
এর এক মাসের মাথায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে আরাকান আর্মির সদস্যদের জলকেলি উৎসব করার খবরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করলো কি না—সেই প্রশ্ন উঠছে।
সুতরাং, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বিজিবি তথা সরকারের তরফে এই ঘটনার বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন যে আসলেই সেখানে কী ঘটেছিল।
যদি আরাকান আর্মির সদস্যরা সত্যিই বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করে এ ধরনের উৎসব করে থাকেন, সেখানে পাহাড়ে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের কেউ যদি অংশ নিয়েও থাকেন বা তাদের সমর্থনও থাকে, তারপরও বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের তরফে একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন।
কেননা এটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বিশেষ করে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত এখন আরাকান আর্মির দখলে বলে যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে—তাতে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে বেশ কিছু কারণে—
১. রাখাইনে আরাকান আর্মির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেখানে মিয়ানমার সরকারের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে যাবে। মিয়ানমার সরকার চাইলেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত পাঠাতে পারবে না। উপরন্তু মিয়ানমার সরকার যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে অন্য কোনো রাজ্যে পুনর্বাসন করবে—তার সম্ভাবনা ক্ষীণ বা এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
২. রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব যত বাড়বে, এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি তত বেশি জটিল হবে। কারণ তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একরকম স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন। রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল করে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়তে থাকলে সেটি রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ‘শাঁখের করাত’ হবে।
৩. সীমান্তে আরাকান আর্মির এই তৎপরতা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করছে। প্রায়ই তারা নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন আটক থাকার পরে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তৎপরতায় তাদের ফেরত আনা হয়। তার মানে, এরইমধ্যে সেখানে একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত এই ইস্যুতে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বা সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সংঘাতের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এরকম চলতে থাকে, তাহলে মিয়ানমারের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৪. এই অঞ্চলে একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে—বিশেষ করে রাখাইন অঞ্চলে। অন্যদিকে ওই এলাকায় চীনের বড় বিনিয়োগ আছে। এই পুরো অঞ্চলে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে চীনের আধিপত্য মোকাবিলায় এখানে মার্কিন স্বার্থও জড়িত। ফলে আরাকান আর্মি কোনো এক বা একাধিক পক্ষের দাবার ঘুঁটি হিসেবে কাজ করছে কি না—তাও বলা যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে বঙ্গোপসাগরের তীরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ভৌগলিক অবস্থানে থাকার কারণে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কী ধরনের বিপদের মধ্যে পড়বে, তা নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে।
৫. সীমান্ত পরিস্থিতি যদি সংঘাতপূর্ণ হয়ে যায় বা যদি সত্যি সত্যিই সেখানে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়ে যায়, তাহলে দেশের চলমান সংস্কার এমনকি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিও দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে কি না—সেটি আরেকটি চিন্তার বিষয়।
প্রসঙ্গত, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। এটি মূলত মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সামরিক শাখা। আরাকান আর্মির কার্যক্রম রাখাইন রাজ্যকেন্দ্রিক হলেও এটি গঠিত হয় চীন সীমান্তবর্তী কাচিন রাজ্যে। তাদের সহায়তা করে আরেক সশস্ত্র সংগঠন ‘কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি’।
গত মার্চে বাংলাদেশ সফরের সময় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেওয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছিলেন, তারা আশা করেন রোহিঙ্গারা আগামী ঈদ নিজ ভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে পালন করবেন। কিন্তু এটি যে বাস্তবসম্মত নয় বা এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে সেখানে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়—সেটি যে কেউই এক বাক্যে মেনে নেবেন। কিন্তু তারপরও জাতিসংঘ মহাসচিব ও বাংলাদেশ সরকার প্রধান কেন এমন দুরাশার কথা বললেন সেটি স্পষ্ট নয়।
এটি যে সম্ভব নয় সে কথা সম্প্রতি সরকারের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাও খোলাখুলিভাবে বলেছেন। গত ১৮ এপ্রিল কক্সবাজার শহরে রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসবে দেওয়া বক্তব্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে; সেখানে এখনই রোহিঙ্গাদের নিরাপদভাবে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা জাতিসংঘসহ সবপক্ষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে রাখাইন রাজ্যে শান্তি এবং স্থিতি অবস্থা ফিরে আসে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করে। আশা করছি আমরা সফলভাবে রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন করতে পারব।’
একই দিন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরাকান আর্মি বড় সমস্যা। তারা রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যাওয়া যাচ্ছে না। আবার তাদের এড়িয়েও এ সংকট সমাধান সম্ভব নয়।
তার মানে মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়ে গেলেন, তার সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই দুজনের বক্তব্যের ফারাক অনেকখানি। কেননা স্বয়ং পররাষ্ট্র উপদেষ্টাই বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরাকান আর্মিই বড় সমস্যা।
তবে এও ঠিক, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের দুটি পথ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মি—দুইপক্ষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেন্টমার্টিনের অবস্থানের কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরের অধিকাংশ এলাকাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। কাজেই ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যকে অনেকটাই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে রাখাইনে যদি আরাকান আর্মির শতভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বড় ধরনের দরকষাকাষির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে অনেকে মনে করেন।
এরকম বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ২১ এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেছেন, কাতার সফরে রোহিঙ্গা বিষয়ক এক সেমিনারে নেতৃত্ব দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি ওঠার আগে এই সেমিনারকে তার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বস্তুত, প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে কথা বলছেন ড. ইউনূস। কিন্তু প্রায় ১২ লাখ মানুষের যে বোঝা বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে বইছে, তার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো আশার আলো এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক তৎপরতা সেই সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলছে কি না—সেটিই বড় প্রশ্ন।
মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন আর কেবল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নয়। এমনকি এটি আঞ্চলিক ইস্যুও নয়। বরং এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। রাখাইন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল, ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক যে ভূরাজনৈতিক অঞ্চল—সেখানে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ স্বার্থ রয়েছে। প্রত্যেকে তার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করবে। ফলে বাংলাদেশ একটি নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে বৃহৎ শক্তিবর্গের এই খেলায় নিরীহ ভিকটিম হয় কি না—সেটিই উদ্বেগের।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক