Sunday, December 22, 2024

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রেক্ষাপট, ভীতি ও বাস্তবতা

Share

সংসদ সদস্য পদ বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের যে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এখনো বিতর্ক হয় এবং যে বিধানকে মনে করা হয় সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠনকালেই।

১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘বাংলাদেশ কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি মেম্বারস (সেসেশন অব মেম্বারশিপ) অর্ডার’ নামে যে আইনটি করা হয়, সেখানে বলা হয়—গণপরিষদের যে সদস্য নিজ দল থেকে পদত্যাগ করবেন বা নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত হবেন, তিনি আর পরিষদের সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন না। তবে এই আদেশের বিধান অনুযায়ী, গণপরিষদের সদস্যপদ হারানো কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো আইন অনুযায়ী অযোগ্য না হন তাহলে তিনি গণপরিষদের শূন্য আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হতে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন না। এই আদেশের অধীনে গৃহীত কোনো আদেশ বা কার্যক্রমকে কোনো আদালত প্রশ্ন করতে পারবে না।

এই আদেশের প্রস্তাবনায় বলা হয়, যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকর ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল, তাই তা নিশ্চিত করার জন্য আইনটি করা হয়েছে।

বাহাত্তর সালেই আপত্তি

১৯৭২ সালে সংবিধান বিলের ৭০ অনুচ্ছেদেও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে সংসদ সদস্যদের পদ বাতিল সম্পর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বললাম, অন্য দেশের সংবিধানে এমনটি নেই। পরে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা আরও কয়েকজন আলোচনা করি। কিন্তু তিনি বললেন, ‌এ দেশের মানুষকে আমি জানি। অনেকেই লোভে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থে এদিক ওদিক করে। সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে গেলে গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার।’

কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমানও (১৯১৫-১৯৮৯) ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজের আপত্তির কথা জানান। তিনি এ বিষয়ে সংবিধান বিলের সঙ্গে নোট অব ডিসেন্ট দেন। শুধু তিনি একা নন, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও চার সদস্য (আসাদুজ্জামান খান, এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেন।

হাফেজ হাবীবুর রহমান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায় না। সংসদ সদস্য পদের এই ধরনের অবসান কেবল একটি স্বৈরাচারী শাসনে পাওয়া যায়, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজ করে। একজন সংসদ সদস্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন, দলের সদস্যদের দ্বারা নন। একবার নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন এবং তখন তিনি কেবল তার রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকেন না। সদস্য পদ বাতিলের এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলের নেতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায়।’

হাফেজ হাবীবুর রহমানের মতে, কোনো দলের কখনোই জনগণের রায় অর্থাৎ নির্বাচন বাতিল করার অধিকার থাকতে পারে না। দলের নেতারা যেখানে তাদের রাজনৈতিক আচরণের জন্য ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ নন, সেখানে একজন সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কার্যকরী সদস্যকে নিয়ন্ত্রণমূলক শাস্তি প্রদানের বিধানের প্রয়োজন হয়, তাহলে ভোটারদের মাধ্যমে তা করার (রিকল) ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দল কর্তৃক বহিষ্কারের ভিত্তিতে সদস্যপদ বাতিলের মতো জঘন্য ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল থাকলে দলীয়ভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে সদস্যরা সংসদীয় দলের বৈঠকেও দলের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাবেন না।

অধিকন্তু, আমাদের দেশে সংসদীয় নেতা ও দলীয় নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম, রীতি বা প্রথা গড়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে একজন দলীয় নেতা ও সংসদীয় নেতা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বা সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে অথবা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এবং সেখানে দলীয় নেতার প্রিয়ভাজনকে স্থলাভিষিক্ত করতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হতে পারে। সুতরাং দল কর্তৃক বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের এমন একটি ঘৃণ্য বিধান একটি দলের মধ্যেও অনেক দ্বন্দ্ব ও অচলাবস্থার জন্ম দেবে। দলীয় শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী এলাকা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সব সময় একই নয় এবং কখনো কখনো তা সাংঘর্ষিক হতে পারে।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ব্যাপারে মত দিলেও তিনি এটিকে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এরকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’

তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে এরকম বিধান যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এজন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারো সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে।

এরকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।

এই অনুচ্ছেদ নিয়ে গণপরিষদে আরও একাধিক সদস্য বক্তব্য রাখেন এবং পরে নুরুল হকের প্রস্তাবক্রমে এই অনুচ্ছেদটি সংশোধিত আকার গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদের ওপর তিনি যে সংশোধনী আনেন সেটি এরকম—কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না। (আসিফ নজরুল, সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১০৮)

স্পিকার এই সংশোধনীটি ভোটে দিলে কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। অর্থাৎ দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধানটি বাদ দেওয়া হয়—যার পেছনে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির একাধিক সদস্যেরও ভূমিকা ছিল। তবে গণপরিষদে বিতর্কের মুখে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে কিছুটা শিথিল করা হলেও এখনও এই বিধানটিকে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে অন্তরায় বলে বিবেচনা করা হয়। এমতাবস্থায় ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদটি লেখা হয় এভাবে:

৭০। (১) কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি

(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা

(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।

অর্থাৎ এখানে দল থেকে বহিষ্কারের বদলে পদত্যাগ শব্দটি যুক্ত করা হয়।

বদলে গেলো ১৯৯১ সালে

১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সময় এই অনুচ্ছেদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে বিধান করা হয়:

(১) কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।

ব্যাখ্যা। যদি কোনো সংসদ-সদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া-

(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা

(খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন,

তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।

(২) কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব নিয়া কোনো প্রশ্ন উদ্ভূত হইলে, সংসদীয় দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের পক্ষে নেতৃত্ব দাবিদার কোনো ব্যক্তি লিখিতভাবে বিষয়টি স্পিকারের কাছে অবহিত করিলে স্পিকার সাত দিনের মধ্যে উক্ত দলের সব সংসদ সদস্যের একটি বৈঠক আহ্বান করিবেন এবং সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করিবেন। আর যদি সংসদে ভোটের ক্ষেত্রে কোনো সদস্য নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ অনুসরণ না করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং ১ দফার অধীনে তাহার সংসদ সদস্য পদ খারিজ হইবে।

(৩) যদি কোনো ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার পর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহা হইলে তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে উক্ত দলের প্রার্থীরূপে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় ৭০ অনুচ্ছেদে আবারও পরিবর্তন আনা হয় এবং ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের বিধান পুনর্বহাল করা হয়।

ভীতি ও বাস্তবতা

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি নিয়ে বারবারই আলোচনা হয় এ কারণে যে, বলা হয় এটি সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত করে। দলের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের চুপ থাকতে বাধ্য করে। অর্থাৎ বিধানটি নিয়ে এক ধরনের ‘ভীতি’ রয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগও ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে।’

বাস্তবতা হলো, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ‘ভীতি’ নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, এর বাস্তবতা নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না।

বর্তমানে ৭০ অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে তাতে দল থেকে পদত্যাগ (বহিষ্কার নয়) এবং সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলেই কেবল কারো সদস্যপদ বাতিল হবে। প্রথম পয়েন্ট নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। তবে গোল বাঁধে দুই নম্বর পয়েন্টে, অর্থাৎ দলের বিপক্ষে ভোট।

বলা হচ্ছে কেউ দলের বিপক্ষে ভোট দিলেই তার সদস্যপদ বাতিল হবে। কিন্তু দলের বিপক্ষে ভোট মানে কী? কোনো সদস্য যদি কোনো বিলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে কি তার সদস্য পদ যাবে? কেননা, বিলের বিপক্ষে অবস্থান মানেই সেটি দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়। দলের বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কেবল যখন ওই দলের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ওপরে ভোটের প্রশ্ন ওঠে।

এরকম পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ সরকারের বাঁচা-মরার প্রশ্নেই কেবল বিপক্ষে ভোটের প্রসঙ্গ আসার কথা। কেননা, অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলে সরকারের পতন হবে। যাতে করে বারবার সরকার বদল না হয় এবং সংসদে অস্থিরতার সৃষ্টি না হয় সে কারণে এই বিধানটি রাখা অন্যায্য নয়। কিন্তু কোনো বিলের বিরুদ্ধে ভোটে সংসদ সদস্যদের নিজের পছন্দ মতো পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে বাধা থাকার কথা নয়।

সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা থাকলে সেখানে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নে ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হকও সাংবাদিকের বলেছিলেন, অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনো বিচারককে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদে দলীয় মতের বিপক্ষে ভোট দিতে ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো বাধা নয়। বরং ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান প্রযোজ্য হবে কেবল সংসদে ওই দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে।

কিন্তু সমস্যা হলো, বছরের পর বছর ধরে এটিই বলা হচ্ছে যে, ৭০ অনুচ্ছেদ মানে সংসদে দলের সব সিদ্ধান্তের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। বস্তুত এটি ৭০ অনুচ্ছেদের একধরনের অপব্যাখ্যা এবং এই ব্যাখ্যা দিয়ে সংসদ সদস্যদের মনে একধরনের ভীতি তৈরি করে রাখা, যাতে তারা দল ও সংসদ নেতার প্রতি শত ভাগ অনুগত থাকেন। যাতে তারা মন খুলে কথা বলতে না পারেন।

৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বছরের বছর ধরে এই ভীতি থাকার আরেকটি কারণ, এই অনুচ্ছেদটি পরীক্ষিত নয়। অর্থাৎ কোনো বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় কারো সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছে এমন কোনো উদাহরণ তৈরি হয়নি। আবার কোনো সংসদ সদস্য সাহস করে বিপক্ষে ভোট দিয়ে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেননি। যদি কেউ এরকম একটি সাহস করতেন এবং যদি সত্যিই তার সদস্যপদ বাতিল হতো, তখন তিনি আদালতের কাছে এর প্রতিকার চাইতে পারতেন। তখন আদালত হয়তো এর একটা ফয়সালা করতেন। সম্ভবত ৭০ অনুচ্ছেদের মূল স্পিরিট বিশ্লেষণ করলে আদালত কেবল বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করতেন। কিন্তু তারপরও এমপিরা সদস্যপদ হারানোর ভয়ে এরকম ঝুঁকি নিতে চাননি।

সমাধান কী?

সংসদীয় কার্যক্রমে সংসদ সদস্যরা যদি স্বাধীনভাবে অংশ নিতে না পারেন, যদি তারা বিলের ব্যাপারে নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ না পান, তাহলে সরকার গণবিরোধী আইনও পাস করিয়ে নিতে পারে। এখন হচ্ছেও তাই। বিলের অনেক বিধানের বিপক্ষে মানসিকভাবে অবস্থান নিলেও ৭০ অনুচ্ছেদের ভয়ে এমপিরা অপছন্দের বিষয়ের সঙ্গেও ‘হ্যাঁ’ বলেন। কিন্তু এরকম ভীতি না থাকলে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আরও বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হতো। সংসদ আরও বেশি প্রাণবন্ত হতো বলে মনে করা হয়।

তবে এমনটিও মনে করা হয় যে, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান থাকা প্রয়োজন। কেননা দল বদল ঠেকাতেই এই বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল। এরকম বিধান না থাকলে এমপিরা যেকোনো সময় দল বদল করে সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। ঘন ঘন সরকার বদল বা এরকম বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়।

কেননা বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও যতটা না আদর্শনির্ভর নয়, তারচেয়ে বেশি ‘সুবিধানির্ভর’। অর্থাৎ দেখা যাবে দেশের যেকোনো সংকটকালে বা অন্য দলের কাছ থেকে বড় সুবিধা পেয়ে বা ভবিষ্যতে বড় কোনো পদের লোভে পড়ে অনেক এমপি দল বদল করে ফেলবেন এবং তাতে সরকারের ভিত নড়ে যাবে। তাই এরকম দলবদল ঠেকাতে ৭০ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করা হয়।

তবে ৭০ অনুচ্ছেদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া মানে কেবল অনাস্থা প্রস্তাব এবং অর্থবিলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করে সংবিধানে আরেকটু সংশোধনী আনা প্রয়োজন। অর্থাৎ বিধানটি স্পষ্ট করে এভাবে লেখা যেতে পারে যে, কোনো সদস্য যদি তার দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে অনাস্থা ভোট এবং অর্থবিলে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। এখানে আরেকটি উপদফা যুক্ত করে লেখা যায়, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিলের বিপক্ষে ভোটদানে কারে সদস্যপদ বাতিল হবে না।

প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে বিএনপির সাবেক এমপি আব্দুল মান্নান ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য একটি বেসরকারি বিল এনেছিলেন সংসদে। যদিও সেটি পাস হয়নি। ওই বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল, কেবল পদত্যাগ এবং সংসদে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলেই সংসদে তার আসন শূন্য হবে। ওই প্রস্তাবিত বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ফ্লোর ক্রসিংয়ের ব্যাপক বিধানকে কেবল মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সীমিত করলে সরকারের স্থায়িত্ব যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি সংসদ সদস্যরা অনেকটা স্বাধীনভাবে সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন।

অনেকের আশঙ্কা, ৭০ অনুচ্ছেদ আরও সহজ এবং তুলনামূলক গণতান্ত্রিক করলেও যে সংসদে এমপিরা নিজের দলের বিপক্ষে যায় এমন বিষয়ে কথা বলবেন—তার সম্ভাবনা কম। কেননা, ১৯৯১ সাল থেকে আমরা একধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা করলেও এখানে ব্যক্তিস্তুতি এতটাই প্রকট ও প্রয়োজনীয় যে, ‍সুযোগ থাকার পরও ঠিক কতজন সংসদ সদস্য নিজের দলের বা দলীয় প্রধানের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করবেন বা করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের অবস্থান কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশ প্রফেসর আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করছে। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (৭০ অনুচ্ছেদের অবাক ব্যাখ্যা) তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে সংসদে কি এমন কোনো উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে সরকারি দল, এমনকি সরকারি জোটের সংসদ সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন? এমনকি যেসব সদস্য বিতর্কে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিলে সংশোধনীর প্রস্তাব করেছেন কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি, তারাও কি ওই সব বিলে সম্মতিসূচক ভোট দেননি? দ্বিতীয়ত, যে সংসদের সংসদ নেতা, দলের সংসদীয় দলের প্রধান, দলের নেতা ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি এবং যার হাতে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা কতটুকু? তৃতীয়ত, যে দেশের প্রধান প্রধান দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অনুপস্থিত, সেখানে কেবল একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ কোনো সংসদ সদস্যকে তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সাহস জোগাবে, এমন মনে করার পেছনে যুক্তি পাওয়া অসম্ভব।’

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ, দফা ও উপ-দফা এমনকি তফসিলগুলোও পর্যালোচনা করছে। বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিচ্ছে। সম্প্রতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কমিশন কাজ করছে।’ অতএব এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই কমিশন সংবিধান সংস্কারে যেসব সুপারিশ করবে, সেখানে ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট মতামত থাকবে। সম্ভবত কমিশনও ৭০ অনুচ্ছেদের পুনর্লিখন বা এমনভাবে সংশোধনের সুপারিশ করবে যাতে এটি সংসদে এমপিদের কথা বলার ক্ষেত্রে বাধা না হয় বা তাদের কণ্ঠরোধ না করে এবং কেবলমাত্র অনাস্থা ভোট ও অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে এমপিরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

Read more

Local News