Sunday, December 22, 2024

ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশের কূটনীতিক মিশনের সুরক্ষা দিতে হবে

Share

বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বৈরি অপপ্রচার ও অপতৎপরতায় আমরা উদ্বিগ্ন। এসব কার্যক্রমের ফল হিসেবে সোমবার দেশটির ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের ওপর হামলা আসে। এই হামলায় ভিয়েনা কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে।

ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী, ভারতে অবস্থিত সব কূটনীতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নয়াদিল্লির ওপর বর্তায়। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই ঘটনাটি একইসঙ্গে একটি বিপদজনক ও উসকানিমূলক আচরণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আরও টানাপড়েন সৃষ্টি ও সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে ভারত এ ঘটনাটিকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে নয়াদিল্লি যদি প্রকৃত অর্থে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘স্থিতিশীল সম্পর্ক’ বজায় রাখার প্রত্যাশা করে থাকে—যেমনটি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে জানিয়েছিলেন—তাহলে দেশটির সরকারকে অস্থিরতা কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং অপতথ্যের খণ্ডন করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা। এ ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না, সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।   

জানা গেছে, সোমবারের হামলার নেপথ্যে ছিল হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামে একটি সংগঠন। এটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সহযোগী সংগঠন। প্রায় ১৫০ বিক্ষোভকারীর একটি দল মিশনের ভেতর ঢুকে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতির মধ্যেই পতাকার খুঁটি ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এবং সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই দিনে ভিএইচপির নেতৃত্বে অপর এক দল বিক্ষোভকারী মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের কাছে অবস্থান নেয়। এর কয়েকদিন আগেই কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের বাইরে বিক্ষোভকারীরা আমাদের পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এ ধরনের বৈরি কার্যক্রমগুলোর মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় দেখা যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। এগুলোর সঙ্গে ঢাকায় সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘিরে পরিচালিত সহিংসতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই গোলযোগের মধ্যে যে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে, তা হলো, এটি একটি আইনি বিষয়, যার সঙ্গে তার ধর্মবিশ্বাসের কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু এই ঘটনাটিকে বাংলাদেশে চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা বয়ানের সর্বশেষ উপাখ্যান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছে।

অপরদিকে, ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী এই ঘটনাগুলোকে (ভারতীয়দের) ‘দীর্ঘদিনের ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি এই অবস্থান নিয়ে সুপরিকল্পিত গোলযোগের পক্ষে যুক্তি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেননি। স্পষ্টতই, এই ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতির স্বার্থ জড়িয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ হল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবৃতি, যেখানে তিনি ‘সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করতে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে কেন্দ্রকে উদ্যোগ নিতে বলেন। বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের গণমাধ্যমের একটি মহল বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়টিকে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা স্থানীয় পর্যায়ে বাড়তি সমর্থন আদায়ের এবং ভারতের নিজস্ব সমস্যাগুলো থেকে জনসাধারণের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়ার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মঙ্গলবার তার দল তৃণমূল কংগ্রেসও (টিএমসি) একই দাবি জানিয়েছে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রশ্ন তোলার সমতুল্য, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।  

আমরা ভারত সরকারকে সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস বিক্ষোভের ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার ও আমাদের কূটনীতিক মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাই। এখন পর্যন্ত আগরতলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সাত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন হতে দেওয়ার দায়ে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে ভারত। তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আরও অনেক বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে, ফ্যাক্ট-চেকিং উদ্যোগের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে অপতথ্যের প্রচার-প্রচারণা খণ্ডন করতে হবে, যা শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে চলমান রয়েছে। আমরা একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ বিষয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাই। তার এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের আগুনে আরও ঘি ঢালার সামিল।   

বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক চায়, যা আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বারবার বলেছেন। যদি ভারতও তা চায়, তাহলে তাদেরকে সেই ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানিয়ে যেকোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানে আলোচনা ও পারস্পরিক সম্মানবোধের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। বৈরিতা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে নয়।

 

Read more

Local News