প্রাবন্ধিক ও গবেষক মোহাম্মদ আজমের সামগ্রিক চিন্তা পদ্ধতি খুব বৈপ্লবিক নয়; তবে বিবর্তনমূলক ও উদারপন্থী। সেই প্রেক্ষিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে লেখা ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ’ বইটি ভিন্নভাবে পাঠ করা যেতে পারে। এতে ৩টি ভাগে ১৬টি প্রবন্ধ রয়েছে। যার বেশিরভাগ এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। এ কারণ হয়তো উৎসর্গও করেছেন সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের একজন- আবুল মনসুর আহমদকে।
সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কখনো এসেছে বাংলা ব্যাকরণের জটিলতর শব্দ, এসেছে গত শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিষয়াদি, আবার কখনো পরিস্থিতি বোঝাতে প্রবন্ধের ভাষা হয়ে উঠেছে স্যাটেয়ার। যেমন, ‘অশ্লীল যুগে বাংলা সিনেমা’ দেখা বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কথা-প্রসঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের জানিয়েছিলাম, আমি হলে গিয়ে ‘বাংলা’ সিনেমা দেখি। এ তথ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ।… এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নাই। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের অনেকেই – বিশেষত মেয়েরা- বিস্ময় প্রকাশ করতে গিয়ে এত বিরাট হা করেছে যে, আমি তাদের অনেকের আলজিব পর্যন্ত দেখে ফেলেছিলাম’।
তবে বইটিতে আদর্শিক জায়গা থেকে আলাপ করার প্রবণতা বেশি। এতে করে প্রাবন্ধিক যেই ভাবাদর্শ দিয়ে বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই অনুযায়ী লেখার বৈশিষ্ট্যগুলো সাজানো হয়েছে। যা অনেকক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে ভীষণ তাত্ত্বিক, আবার কিছু ক্ষেত্রে তা আংশিকও বটে।
‘আহমেদ ছফা প্রণীত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাজা রামমোহন রায়কে বিশ্লেষণ করার তরিকাকে লেখা হয়েছে ‘রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্ব তালাশ করার এ কেতা অনেকেই হয়ত অনুমোদন করবেন না’। রামমোহনকে বাহাদুর শাহ যখন রাজা উপাধি দেন, তখন তার নিজেরই রাজত্ব নাই। কিন্তু রামমোহন রায় আমৃত্যু সেই উপাধিকে ধারণ করার বিষয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সমালোচনাকেও প্রবন্ধে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিকে বিচার করার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘ছোট ছোট গল্পগাছা ব্যক্তিকে বোঝার ক্ষেত্রে রাজ্জাক সাহেবের এক প্রধান অবলম্বন’ বলেই মনে করেন মোহাম্মদ আজম।
মুশকিল হলো, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের রামমোহন রায় বিশ্লেষণ যতটা না ‘ব্যক্তিত্ব তালাশ’, তার চাইতেও বেশি আঠারো শতকের সময়ের ধারাবাহিকতায় ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ ও মধ্যবিত্তের শিক্ষায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে বের করার প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ মাত্র। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থ ‘পলিটিকাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’ বইতে রাজা রামমোহন রায়ের সেসময়কার ভূমিকা পরবর্তী ভারতীয় সাহিত্যের সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করা হয়েছে। ‘দ্য মাইন্ড অফ দ্য এজুকেটেড মিডেল ক্লাস ইন ইন্ডিয়া’ অধ্যায়তে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দেখিয়েছেন, আঠারো শতকের শুরুতে রাজা রামমোহন রায় থেকে বিবেকানন্দ সেসময়ের সাহিত্যে ধর্মীয় ভাবাদর্শের পুনর্নির্মাণ শুরু করেছিলেন, তা আঠারো শতকের মাঝামাঝি এসে বঙ্কিম চন্দ্র সাহিত্যের মাধ্যমে তার ধারাবাহিকতা চালিয়ে গেছেন। এমনকি বঙ্কিমের লেখা ‘বন্দে মা তারাম’ গানটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ‘মুসলিম’ শত্রুদের বিরুদ্ধে উজ্জেবিত করার সঙ্গীত হিসেবেও আবদুর রাজ্জাক বিবেচনা করেছেন।
‘Bankim Has remained the most widely read author in Bengal. Along with those who were concerned exclusively with reconstruction of religious thought and practice, beginning with Ram Mohon Roy to Vivekananda, Bankim dominates the field of creative activity during the 19th century. His song ‘Vande Mataram’ continues to be an abiding monument to the hold he had on the intellect and the imagination of the people to this day. This song occurs in his most widely read book ‘Ananda Math’. … This invocation to “mother” (Vande Mataram) is the war song of the songs going to battle against the infidel (Muslim). The book is the work of a genius who has employed the whole of his talent in the creation of a hymn of hatred against the Muslims. [Political Parties in India by Prof. Abdur Razzaq]
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের চোখে রাজা রামমোহন রায় নেহায়েত কোন ‘ব্যক্তি’ নয়; বরং এই অঞ্চলে আঠারো শতকের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ভাবাদর্শিক এক পরম্পরা মাত্র। তাই মোহাম্মদ আজমের করা রাজা রামমোহন রায় প্রশ্নে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বোঝাপড়া বেশ অসম্পূর্ণ বলেই বোধ করি। হয়তোবা উপনিবেশায়ন পাঠে রাজা রামমোহন রায়ের আধুনিকতা পাঠ থেকে প্রাবন্ধিক আজম বের হতে পারেননি।
তবে উপনিবেশায়নের আলাপে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কৃতির রাজনীতি নিয়ে এই বইতেই আরেকটি প্রবন্ধ রয়েছে। পতন হওয়া আওয়ামী শাসনকে বিশ্লেষণ করতে বইটির ‘উপনিবেশিতের ধর্ম ও সংস্কৃতি এবং নয়া-সাম্রাজ্যবাদী জমানায় ‘মৌলবাদী’ সন্ত্রাস’ প্রবন্ধটি আলোচনায় আনা যেতে পারে। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বলা হচ্ছে, উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের একটা প্রধান কারণ শাসক পক্ষের শ্রেষ্ঠত্বের সম্পর্কে উপনিবেশিদের সম্যক সম্মতি আদায়ের সাফল্য। এর ফলে শাসিত এলিটরা কথা বলে শাসকের সুরে। উপনিবেশ তত্ত্বের পণ্ডিতেরা এ বস্তুকেই বলেছেন মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়ন।
আওয়ামীলীগ বিবেচনায় এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের প্রমাণ বেশ দৃশ্যমান। গত শাসনামলে অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা, আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় ‘কালচারাল ইজারাদার’ প্রমুখেরা কথা বলতেন শাসকের ভাষায়। এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আজম উপনিবেশায়নের যেসব তরিকা দেখিয়েছেন, তা বেশিরভাগ ইদানীং ঘটা বাস্তবপন্থী।
এছাড়াও আজম বলছেন, উপনিবেশিত বাংলার সমাজে ও রাজনীতিতে ধর্মীয় ‘রক্ষণশীলতা’র দীর্ঘমেয়াদী প্রতাপ দেখা গেছে, এবং এ ধারার প্রচারক ও অনুসারীরা প্রায় সকলেই পশ্চিমা-শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। গত শাসনামলে আমরা পহেলা বৈশাখে চারুকলার আয়োজনকে ধর্ম ও সংস্কৃতির জায়গা থেকে বেশ ‘বাইনারি’ অবস্থান দেখতে পাই। এবং পশ্চিমা-শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরাও বিভিন্ন ধর্মীয় আয়োজনে রক্ষণশীলতার বয়ান দিতে উপস্থিত হতে দেখি। ধর্মীয় সমাজে নিশ্চিতভাবেই পহেলা বৈশাখের আয়োজন অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উপনিবেশিত সমাজে মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের সংজ্ঞা তৈরি করতে শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতির রাজনীতির যে মুখোমুখি অবস্থান, আওয়ামী সরকার টিকে থাকার জন্যই এই দ্বৈত অবস্থান তৈরির দরকার ছিল। পূর্বের সরকারের সংস্কৃতির রাজনীতি বুঝতে এই প্রবন্ধটি বেশ প্রাসঙ্গিক।
এমনকি মোহাম্মদ আজম এই বইতে যা প্রস্তাব করেছেন তা থেকে স্পষ্ট যে, আলোচ্য বেশ কিছু উপায়ে সাংস্কৃতিক রাজনীতি করার মাধ্যমেই আওয়ামীলীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তাদের সরকারের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিল। তবে ১৪ ও ১৮ সালে গঠন করা সরকারের সাংস্কৃতিক নিপীড়নের আলাপ এই বইতে নাই বললেই চলে। আলথুসারের কথা ধার করে যদি রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র নিপীড়ন বাদী হিসেবেই ধরা হয় এবং ১৪ ও ১৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেভাবে সাংস্কৃতিক রাজনীতি করেছে তা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে দৃশ্যমান পরিস্থিতির চেয়েও দৃশ্য অবতারণার পেছনের বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, দৃশ্যমান উন্নয়নের পেছনেই থাকে ভয়ঙ্কর অসমতার গল্প। ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টসের শিক্ষক ও লেখক সুমন রহমান নিজেও এই বইটির আলোচনা করতে গিয়ে এমন মতামত ব্যক্ত করেন যে, বইটির পাঠ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হবে, যদি আজমের এই প্রস্তাবকে বাইরে রাখা যায়।
আমরা যারা শূন্য দশকে বিভিন্ন চিন্তার সাথে পরিচিত হচ্ছি, মনে হয় আশি-নব্বই দশকে যারা সাংস্কৃতিক চিন্তার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, উত্তরাধিকারের কারণেই হোক বা অন্য কারণে তাদের চিন্তাকে বিশ্লেষণ করার টেক্সট জরুরি। মোহাম্মদ আজম ঠিক এই বিষয়টি ধরেছেন, সেসময়ের বিচ্ছিন্ন চিন্তাগুলোকে একটি বড় পরিসরে নিয়ে এসেছেন। সংহতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটি মূলত বিচ্ছিন্ন সেসব চিন্তার সাথেই পরিচয় করিয়ে দেবে, যেগুলো এই সময়ের পরম্পরা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।